ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউ.এন.ডি.পি এবং বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ানে পরিচালিত হচ্ছে গ্রাম আদালত। গ্রাম আদালত প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৬ বছরে প্রায় ৮৭ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে যার মধ্যে ৬৯ হাজার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং প্রতিটি মামলা নিষ্পত্তির জন্য গড়ে সময় লেগেছে মাত্র ২৮ দিন, অথচ প্রচলিত আদালতে একই ধরেনের একটি মামলা নিষ্পত্তির সময় লাগে গড়ে ৫ বছর।
গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ ১৯৭৬ এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম গ্রাম আদালত পরিচালিত হয়ে থাকলেও এটাকে রহিত করে গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ কার্যকর হয় এবং এই আইনে আবার ২০১৩ সালে সংশোধনি আনা হয়।
আজকের এই পোস্টে আমি আপনাদের সাথে আলোচনা করব- গ্রাম আদালতের সুবিধা কি, কি ধরনের বিরোধ গ্রাম আদালত নিষ্পত্তি করতে পারে, কি ভাবে এখানে আবেদন করতে হয় এবং কি ধরনের রায় প্রদান করা হয় সে সম্পর্কে।
গ্রাম আদালতের সুবিধাঃ
গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী গ্রাম আদালত সর্বচ্চ ৭৫,০০০ টাকা মূল্যমানের ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে।
· নিজ ইউনিয়ন পরিষদেই বসেই আদালতের সুবিধা পাওয়া যায়।
· বিচারিক প্যানেলে নিজের প্রতিনিধি নিজেই মনোনয়ন দেওয়া যায়।
· আবেদনকারী এবং প্রতিবাদী নিজেরাই নিজেদের কথা বলতে পারেন, তাই আইনজীবী নিয়োগের দরকার হয় না।
গ্রাম আদালত যে সব বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে-
· চুরি, ঝগড়া-বিবাদ, কলহ বা মারামারি, দাঙা, প্রতারণা, ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেয়া, কোন নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা, উত্যাক্ত করা
· গচ্ছিত কোন মূল্যবান সম্পত্তি আত্নসাৎ করা, পাওনা টাকা আদায়, স্থাবর সম্পত্তির দখল ও পুনরুদ্ধার
· অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কোন অস্থাবর সম্পত্তির জবর দখল বা ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়
· গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশর কারণে ক্ষতিপূরণ, গবাদিপশু মেরে ফেলা বা গবাদিপশুর ক্ষতি করা
· কৃষি শ্রমিকের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ আদায় ইত্যদি বিরোধ গ্রাম আদালত নিষ্পত্তি করতে পারে।
গ্রাম আদালতে আবেদন দাখিল
· ইউনিয়ন পরিষধ থেকে আবেদন ফরম সংগ্রহ করে অথবা কাগজে প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখপূর্বক যথাযতভাবে পূরণ করতে হবে
· পূরণকৃত আবেদন পত্র ইউনিয়ন পরিশধের চেয়ারম্যান বরাবর দাখিল কতে হবে
· ফৌজদারি মামলার জন্য ১০ টাকা এবং দেওয়ানী মামলার জন্য ২০ টাকা ফি দিতে হবে, এছাড়া আর কোন খরচ নেই।
গ্রাম আদালতের বিচারিক প্যানেল
- ইউনিয়ন পরিশোধের চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান।
বিচারিক প্যানেলে আবেদনকারী ও প্রতিবাদী উভয় পক্ষ থেকে মনোনীত ২ জন করে ৪ জন এবং চেয়্যারম্যান সহ মোট পাঁচ জন বিচারক থাকবেন।
- কোন পক্ষ চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের পরিবর্তে অন্য কোন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসাবে মনোয়ন করতে পারেন।
- চেয়ারম্যানের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন পক্ষের আপত্তি থাকলে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (UNO) বরাবর লিখিত আবেদন করতে হবে। ইউএনও আবেদন যথার্থ মনে করলে, ইউনিয়ন পরিষধের যে কোন সদস্যকে তিনি গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ করতে পারেন।
- গ্রাম আদালতে কোন এডভোকেট বা আইনজীবী নিয়োগ করা যায় না।
গ্রাম আদালতে মামলা দায়েরের তামাদি বা সময়সীমা
- ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্র বিরোধীয় ঘটনা ঘটার ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করেতে হবে।
- দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে বিরোধীয় ঘটনা ঘটার ৬০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তবে স্থাবর সম্পত্তি বেদখল হওয়ার ১ বছরের মধ্যে এর দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করা যাবে।
বিচার প্রক্রিয়ার নারীদের অংশগ্রহণ
যে কোন বিচার প্রক্রিয়ার মতোই গ্রাম আদালতের বিচার প্রক্তিয়ার নারী-পুরুষ সবার সমান অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। নারীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ কর্তৃক নারী সদস্য মনোনয়ন দেয়া বাধ্যতামূলক।
গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত ও আপীল
- গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিচারিক প্যানেলের ৫ জনই একমত হলে অথবা ৫ জনের মধ্যে ৪ জনই একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে, এ বিষয়ে আপীল করা যাবে না।
- সিধান্তের দিন বিচারিক প্যানেলে যদি ৪ জন থাকে এবং তাদের মধ্যে ৩ জন একমত হন, তাহলেও আপীল করা যাবে না।
- তবে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যদি ৫ জনের মধ্যে ৩ জন একমত এবং ২ জন ভিন্নমত পোষণ করেন, তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ৩০ দিনের মধ্যে উপযুক্ত আদালতে আপীল করা যাবে।
গ্রাম আদালত কোন শাস্তি, জেল বা কারাদন্ড দিতে পারেনা, এটা শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে ক্ষতিপূরণের আদশ দিতে পারে। গ্রাম আদালত ‘গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এর তফসিলের প্রথম অংশে বর্ণিত ফৌজদারী অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে কেবলমাত্র সর্বোচ্চ ৭৫ (পঁচাত্তর) হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ প্রদান করতে পারে৷
গ্রাম আদালত নিয়ে তৈরি করা ইউটিউব ভিডিয়োটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন
গ্রাম আদালত মূল ধারায় আদালতের বিকল্প না হলেও গ্রাম এলাকার ছোট-খাট বিবাধ নিরসনে এটি কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে। আমি ভিডিও ডিস্ক্রিপশ্নে সম্পূর্ন আইনটির লিঙ্ক দিয়ে দিব, আপনারা চাইলে স্মপূর্ন আইনটি পড়ে নিতে পারেন।
দেখা হবে পরবর্তী পোস্টে, সেই পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
0 Comments