আজকের এই আর্টিকেলের আমরা আলোচনা করব, আয়কর কাদের উপর প্রযোজ্য, কোন ধরনের আয়ের উপর কর দিতে হয়, একজন ব্যক্তির কি পরিমান ইনকাম হলে তাকে আয়কর দিতে হয়, আয়কর প্রদানের সময়সীমা এবং আয়কর হার ইত্যাদি সম্পর্কে।
আয় করের খাত সমূহ / কোন কোন আয় করের আওয়তা ভুক্ত
ইনকামট্যাক্স অর্ডিন্যান্স- ১৯৮৪ অনুযায়ী ৭ ধরনের খাত থেকে আয়, আয় করের আওতায় পড়ে
১। বেতনাদি
২। নিরাপত্তা জামানতের উপর সুদ
৩। গৃহ সম্পত্তির আয়
৪। কৃষি আয়
৫। ব্যবসা বা পেশার আয়
৬। মূলধনি মুনাফা
৭। অন্যান্ন উৎস হতে আয়
তবে রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় ফার্মের আয়ের অংশ এবং স্বামি, স্ত্রী বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের আয়ের খাতগুলিও সম্পৃক্ত হবে।
আয়কর সীমাঃ
সাধারণ ভাবে কোন ব্যক্তির বার্ষিক আয় যদি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হয় তাহলে তাকে আয় কর রিটার্ণ জমা দিয়ে হবে।
মহিলা বা ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা অতিক্রম করলে, প্রতিবন্ধি করদাতার আয় বছরে ৪ লাখ টাকার বেশি হলে এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর দাতার আয় বছরে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার বেশি হলে তাদের কে আয়কর রিটার্ণ দাখিল করতে হবে। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে আয়ের পরিমান যাই হোক না কেন, কর দাতা কে আয়কর রিটার্ণ দাখিল করতে হবে।
করোনাভাইরাস মহামারি ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে মানুষের
আয় কমে যাওয়ায়, ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে ২০২০-২১
অর্থবছরের বাজেটে।
পুরুষ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। নারী, প্রতিবন্ধী ও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সীমা বাড়ছে আনুপাতিক হারে। প্রত্যক্ষ করদাতার সংখ্যা বাড়াতে দীর্ঘদিন এই আয় সীমা বাড়ায়নি সরকার।
এ ছাড়া, সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, ৩ লাখ টাকার পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, ৪ লাখ পর্যন্ত ১৫ শতাংশ ও ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ পর্যন্ত আয়করের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর বেশি আয় হলে, মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ আয়করের প্রস্তাব রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। বর্তমানে ৪৭ লাখ টাকার বেশি আয় হলে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দেওয়ার বিধান রয়েছে।
আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ অনুযায়ী করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলে, জাতীয় রাজস্ববোর্ডের অন্তর্গত কোন সার্কেল অফিস থেকে করদাতা হিসাবে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর অথবা অনলাইনে রেজিষ্টেশন করে ১২ ডিজিটের ই-টিন নম্বর সংগ্রহ করতে হবে।
যে সকল ব্যক্তিকে আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে, তারা হল-আয়ের পরিমান যা-ই হোক না কেনো, ব্যক্তি করদাতাকে সংশ্লিষ্ট আয় বছরের জন্য অবশ্যই আয়কর বিবরণী দাখিল করতে যাদের-
১। কোনো কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার পরিচালক বা শেয়ার হোল্ডার চাকরিজীবী।
২। কোন ফার্মের অংশীদার।
৩। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হয়ে আয় বছরের যে কোনো সময় ১৬ হাজার টাকা বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ মূল বেতন আহরণ করে থাকলে।
৪। কোনো ব্যবসায় বা পেশায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদে, যে নামেই অভিহিত হোক না কেনো, বেতনভোগী কর্মী হয়ে থাকলে।
এর বাইরে কিছু ক্ষেত্রে শর্ত স্বরূপ আয়কর বিবরণী দেখাতে হয়। যেমন, জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী, সমাজের কোনো প্রতিষ্ঠীত ক্লাবের সদস্য ইত্যাদি।
যেসব ক্ষেত্রে এমন শর্ত রয়েছে যে বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে আয়কর বিবরণী দাখল করতে হবে সেগুলো হল-
* মোটর গাড়ির মালিক (মোটর গাড়ি বলতে জিপ বা মাইক্রোবাসকেও বোঝাবে)।
* মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্য।
* কোনো সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ হতে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে কোনো ব্যবসা বা পেশা পরিচালনা করে থাকেন এমন ব্যক্তি।
* চিকিৎসক, দন্তচিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি অথবা সার্ভেয়ার হিসেবে বা সমজাতীয় পেশাজীবী হিসেবে কোনো স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার নিবন্ধনভূক্ত ব্যক্তি।
* জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত আয়কর পেশাজীবী।
* কোনো বণিক বা শিল্প বিষয়ক চেম্বার বা ব্যবসায়িক সংঘ বা সংস্থার সদস্য।
* কোনো পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের কোনো পদে বা সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হওয়া।
* কোনো সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা কোনো স্থানীয় সরকারের কোনো দরপত্রে অংশগ্রহণকারী।
* কোনো কোম্পানির বা কোন গ্রুপ অফ কোম্পানিজের পরিচালনা পর্ষদে থাকা।
রিটার্ণ দাখিলের সময়সীমা
আমাদের আয়-বর্ষ জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত। এরপর থেকেই অর্থাৎ জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকেই আয়কর বিবরণী দাখিল করা শুরু হয়ে যায়।
টানা চলতে থাকে কর দিবস পর্যন্ত। বাংলাদেশে কর দিবস পালিত হয় ৩০ নভেম্বর। অর্থাৎ ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত যে কোনো ব্যক্তি করদাতা তার আয়কর বিবরণী দাখিল করতে পারবেন।
আপনার আয়কর রিটার্ন আপনি রাজস্ববোর্ডের অন্তর্গত কোন সার্কেল অফিসে, বা আয়কর মেলায় গিয়ে কিংবা ঘরে বসে অনলাইনে জমা দিতে পারেন।
আয়কর হিসাব
আয়কর হিসাব বের করা পানির মত সহজ নয়। আয়কর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটু হিসাব নিকাশ এবং অঙ্ক করার প্রয়োজন হয়।
সাধারনত ব্যক্তি শেনীর কর দাতার ক্ষেত্রে কর হারের কাঠামো হলো
|
মোট আয় |
কর হার |
(ক) |
প্রথম ২,৫০,০০০/- টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের উপর |
শূণ্য |
(খ) |
পরবর্তী ৪,০০,০০০/- টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের উপর |
১০% |
(গ) |
পরবর্তী ৫,০০,০০/- টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের উপর |
১৫% |
(ঘ) |
পরবর্তী ৬,০০,০০০/- টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের উপর |
২০% |
(ঙ) |
পরবর্তী ৩০,০০,০০০/- টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের উপর |
২৫% |
(চ) |
অবশিষ্ট মোট আয়ের উপর |
৩০% |
এরপর আপনাকে বের করতে হবে, কোন কোন আয়ের কর দেওয়া লাগবে, কত টাকা বা কত শতাংশ দেওয়া লাগবে।
আয়কর একেক ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। চাকুরিজীবির একরক তো ব্যবসায়ীর অন্যরকম, আবার কোম্পানী এবং আর্টিফিসিয়াল লিগ্যাল পারসোনের অন্যরকম।
চাকরিজীবী করদাতাদের মূল বেতন, বিশেষ বেতন, বোনাস, মহার্ঘ ভাতা সবই করযোগ্য আয়। যেমন, কোনো চাকরিজীবীর মূল বেতন যদি মাসে ৩০ হাজার টাকা হয়, তাহলে বছর শেষে ওই ১২ মাসের মূল বেতন যোগ হয়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা করযোগ্য আয়। যদি দুটি উৎসব মূল বেতনের সমান হয়, তাহলে আরও ৬০ হাজার টাকা যুক্ত হবে। মহার্ঘ ভাতা থাকলেও কর বিবরণীতে যোগ করতে হবে।
চাকরিজীবীদের বাড়িভাড়ায় কর ছাড় মিলবে। ওই চাকরিজীবী বাড়িভাড়া বাবদ ওই মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বা মাসিক ২৫ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, তা করমুক্ত। ধরা যাক, একজন চাকরিজীবীর সারা বছরের মূল বেতন হলো ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ওই চাকরিজীবী বাড়িভাড়ায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যাবে। একইভাবে ওই চাকরিজীবীর চিকিৎসাভাতায় ছাড় মিলবে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম, সেটি। সে ক্ষেত্রে ওই চাকরিজীবী ৩৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কর ছাড় পাবেন।
যদি বেতনের সঙ্গে নিয়োগকর্তা যাতায়াত বাবদ খরচ দেন। সেখানেও বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত কর দিতে হবে না। তবে কোনো চাকরিজীবী যদি অফিস থেকে গাড়ি পান, তাহলে মূল বেতনের ৫ শতাংশ বা বছরে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত করমুক্ত থাকবে।
যদি আপনার হৃদ্রোগ, কিডনি, চক্ষু, লিভার ও ক্যানসারের মতো জীবননাশী রোগে ভোগেন, তবে সার্জারির খরচের জন্য আপনার অফিস যত টাকা দেবেন, তা পুরোটাই করমুক্ত। তবে কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক এই সুবিধা পাবেন না।
অনেক চাকরিজীবী নিজের অফিসের ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ড থেকে বিপদে-আপদে টাকা পান। এ ধরনের তহবিল থেকে ৫০ হাজার টাকা পেলেও তা করযোগ্য নয়।
অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্মীদের ছুটির বিপরীতে নগদ টাকা দিয়ে দেন অর্থ্যাৎ পেইড লিভ। এ ধরনের ছুটি নগদায়নের টাকাও করমুক্ত। তবে তা বছরে ৬০ হাজার টাকার কম হতে হবে। অবসর গ্রহণের পর গ্র্যাচুইটি বাবদ আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত করমুক্ত।
বাড়িভাড়া বাবদ পুরো আয়ের ওপর কর বসবে না। আবাসিক ভাড়া দিলে বার্ষিক আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ দেখিয়ে রেয়াত মিলবে। বাণিজ্যিক ভাড়ার ক্ষেত্রে এই হার ৩০ শতাংশ। কোনো মাসে ফ্ল্যাট ভাড়া না হলে তা বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া বাদ যাবে পৌর কর, ভূমি রাজস্ব, গৃহনির্মাণের কিস্তির টাকা।
তো বন্ধুরা বুঝতেই পারছেন এই করযোগ্য আয় বের করার জন্য বেশ হিসাব নিকাশ করার প্রয়োজন হয়।
আয়করের এই সমস্তু বিষয়গুলি হ্যান্ডেল করার জন্য বিভিন্ন ইনকামট্যাক্স ল-ইয়ার, একাউন্টিং ফার্ম, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, কনসালটেন্সি ফার্ম রয়েছে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়কর সংক্রান্ত কাজে সহায়তা করে থাকে।
তবে আপনি যদি ব্যক্তি আয়কর দাতা হন বা ছোট পরিসরে ব্যবসা করে থাকে এবং নিজের আয়কর নিজেই হিসাব করা শিখতে চান তাহলে ১৩৬ পৃষ্টার আয়কর হিসাব ও রিটার্ণ দাখিলের নির্দেশিকা বইটি আমাদের নিকট থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। যার মাধমে আপনি আয় কর হিসাব করা, ফর্ম এর নমুনা, রিটার্ণ প্রস্তুত এবং দাখিল করার পদ্ধতিসহ নানাবিধ প্রয়োজনীয় বিষয় বিস্তারিত ভাবে জানতে ও শিখতে পারবেন। পিডিএফ ফাইলের মূল্য- ১০০ টাকা।পিডিএফ এর জন্য ইমেইল অথবা ফেসবুক পেজে ইনবক্স করুন। বইটির সূচীপত্রের কিছু অংশ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন।
তো বন্ধুরা আজকের ব্লগ এই পর্যন্তই, ইনশাল্লাহ দেখা হবে পরবর্তী ব্লগে, সে পর্যন্ত ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।
0 Comments