উইল বা অছিয়ত হলো আরবী শব্দ। উইল (testament) বা অছিয়ত হলো ভবিষ্যৎ দান। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি বা সম্পত্তির মুনাফা কিভাবে বিলি-বন্টন করা হবে তা তার মৃত্যুর পূর্বেই লিখিত বা মৌখিকভাবে নির্ধারণ করে যাওয়ার আইন সম্মত ঘোষণাই হলো উইল বা অছিয়ত।
উইল করা যায়
(ক) ব্যক্তির উদ্দেশ্যে এবং
(খ) ধর্মীয় উদ্দেশ্যে।
ব্যক্তির উদ্দেশ্যে উইল আবার দুই প্রকার
(১) ওয়ারিশের বরাবরে উইল এবং
(২) ওয়ারিশ নয় এমন ব্যক্তির বরাবরে উইল।
ওয়ারিশের বরাবরে সম্পাদিত উইলের ক্ষেত্রে-
(ক) অন্য ওয়ারিশদের সম্মতি না থাকলে উইল বাতিল বলে গণ্য হবে।
(খ) অন্য ওয়ারিশদের সম্মতি থাকলে উইল সম্পূর্ণ কার্যকরী হবে।
(গ) ওয়ারিশদের সম্মতি কার্যকর হবে উইল দাতার মৃত্যুর পর।
ওয়ারিশ নয় এমন ব্যক্তি বরাবরে সম্পাদিত উইলের বিধান
(ক) ওয়ারিশদের সম্মতি থাকলে উইল সম্পূর্ণ কার্যকরী হবে।
(খ) ওয়ারিশদের সম্মতি না থাকলে উইল দাতার নিট সম্পত্তির ১/৩ এর উপর উইল কার্যকরী হবে।
একজন মুসলমান তার সমূদয় সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগের বেশি উত্তরাধিকার নয় এমন কাউকে উইল করতে পারে না। তবে উত্তরাধিকারদের মধ্যে মোট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগের বেশি উইল করতে পারে। ১৯৯৬ সালের হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ মোতাবেক আইনত বৈধ।
নিট সম্পত্তি
উইলদাতার মোট সম্পত্তি হতে নিন্মবরূপ ব্যয় পরিশোধের পর অবশিষ্ট সম্পত্তি নিট সম্পত্তি বলে গণ্য হবে, উইল সর্বদা নিট সম্পত্তির উপর প্রযোজ্য হবেঃ
(ক) উইল দাতার মৃত্যুর অব্যবহিত ৩ মাস পূর্বের ভৃত্য বা চাকরের পাওয়ানাদি।
(খ) মৃত্যু শয্যাকালীন খরচাদি।
(গ) মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের খরচ।
(ঘ) স্ত্রীর দেন-মোহরের পাওয়ানা পরিশোধ ব্যয়।
(ঙ) উইল প্রবেট এবং সাকসেশন সার্টিফিকেট ব্যয়।
(চ) ঋণ পরিশোধ (আগের ঋণ আগে পরিশোধ ভিত্তিতে)।
(ছ) ঋণ পরিশোধের আগে স্ত্রীর দেন-মোহর পরিশোধ করতে হবে।
ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উইল
ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উইল করা হলে তাতে ওয়ারিশদের সম্মতি থাকলে সে উইল সম্পূর্ণ কার্যকর হবে, আর ওয়ারিশদের সম্মতি না থাকলে অছিতকারীর নিট সম্পত্তির ১/৩ অংশের উপর উইল কার্যকরী হবে।
ধর্মীয় উইল ৩ প্রকার
যথা-
(১) ফরজ কাজের উদ্দেশ্যে, যেমন- হজ্জ্ব পালন, যাকাত প্রদান ইত্যাদি।
(২) ওয়াজিব কাজের উদ্দেশ্যে, যেমন- ফিতরা প্রদান, কোরবানী করা ইত্যাদি।
(৩) নফল কাজের উদ্দেশ্যে, যেমন- সরাইখানা, রাস্তা-পুল, এতিমখানা নির্মাণ ইত্যাদি।
ধর্মীয় উদ্দেশ্যে উইল করা হলে তাতে ওয়ারিশদের সম্মতি থাকলে সে উইল সম্পূর্ণ কার্যকর হবে, আর ওয়ারিশদের সম্মতি না থাকলে অছিতকারীর নিট সম্পত্তির ১/৩ অংশের উপর উইল কার্যকরী হবে।
উইলের উপাদান
(১) একই সম্পত্তি নিয়ে একাধিক উইল করা হলে সর্বশেষ উইলটি সর্বপ্রথম কার্যকরী হবে এবং সম্পত্তি অবশিষ্ট থাকা সাপেক্ষে পরবর্তী উইলগুলো কার্যকরী হবে।
(২) অজাত ব্যক্তি উইলের তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে জন্মগ্রহণ করলে তার বরাবরে করা উইল বৈধ হবে।
(৩) উইল মৌখিক ও লিখিত দু’ভাবেই করা যায়। এমনকি অসামর্থ্যের কারণে ইঙ্গিতেও করা যায়। তবে মৌখিক উইলের ক্ষেত্রে ২ জন পুরুষ বা ১ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সাক্ষীর উপস্থিতিতে হতে হবে।
(৪) নাবালক উত্তরাধিকারী সাবলকত্ব লাভের পর উইলে সম্মতি দিতে পারবেন।
(৫) উইল দাতা মৃত্যুর পূর্বে যে কোন সময় উইল বাতিল করতে পারেন। সম্পত্তি একবার উইল করার পর পুনরায় তা অন্য কারো অনুকূলে উইল করলে পূর্বের উইলটি স্বয়ংক্রীয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে। উইল বাতিলের জন্য মামলার প্রয়োজন হয় না।
(৬) ১৮৭০ সনের হিন্দু আইন অনুসারে একজন হিন্দু তার সকল সম্পত্তি উইল করতে পারেন, তবে যাদের ভরণপোষনের জন্য তিনি আইনত বাধ্য তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রেখে বাকী সম্পত্তি উইল করতে হবে।
(৭) উইলকারীর কোন উত্তরাধিকারী না থাকলে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে উইল করে দিতে পারেন।
(৮) উইল গ্রহণকারীকে দাতার মৃত্যুর সময় জীবিত থাকতে হবে।
(৯) উইলকারী মৃত্যুর মুহূর্ত হতে উইল কার্যকর হবে।
যে সকল কারনে একটা উইল বাতিল বা বিলুপ্ত হতে পারে
(১) উইলের পর উইলদাতা বিকৃত মস্তিষ্ক হলে, মৃত্যুর পূর্বে তিনি সুস্থ হলেও।
(২) উইল গ্রহীতা দাতার আগে মারা গেলে।
(৩) উইল দাতা বা গ্রহীতা ধর্ম ত্যাগ করলে
(৪) উইল গ্রহীতা দাতাকে হত্যা করলে।
(৫) উইলকৃত সম্পত্তির উপর অন্য কারো অধিকার সাব্যস্ত হলে।
(৬) উইলকারী উইলকৃত সম্পত্তি বিক্রি বা দান করলে বা তাতে বাড়ি তৈরি করলে।
উইল প্রবেট
উইল বা অছিয়তের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে তার সম্পত্তি উইল করে গেলে উইলটি বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দেওয়ানি আদালতের অনুমোদন বা জুডিশিয়াল কনর্ফমেশন লাগবে, এরূপ অনুমোদন নেয়াকেই বলে উইল প্রবেট।
প্রবেট মুসলিম উইলে আবশ্যকীয় নয়। প্রবেটের জন্য আদালতে আবেদন করা হলে অন্যান্ন ওয়ারিশদের মতামত জানার জন্য আদালত হতে নোটিশ দেয়া হয়, এ সময় ওয়ারিশগণ উইলের বিরুদ্ধে অসম্মতি জানাতে পারেন। এছাড়া আদালত কালেক্টরের নিকট সম্পত্তির কোর্ট ফি সঠিক আছে কিনা, সম্পত্তিটি সরকারের কিনা, সম্পত্তিটি উইলদাতার কিনা এতে আর কারো স্বার্থ আছে কিনা ইত্যাদি জানতে চেয়ে থাকেন।
উইলের রেরিস্ট্রেশনঃ
উইল এবং অছিয়ত হল একমাত্র দলিল যা রেজিষ্ট্রি করার প্রয়োজন পড়ে না, রেজিস্ট্রেশন আইনের ১৮ ধারামতে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তবে সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস আবেদন করলে উইল সম্পর্কিত রেজিষ্ট্রার অন্তর্ভূক্তি করানো যায়।
হেবা বা দান ও উইলের মধ্যে পার্থক্য
(১) দান সাথে সাথে কার্যকর হয়, উইল কার্যকর হয় অছিয়তকারীর মৃত্যুর পর।
(২) দান সম্পন্ন হওয়ার পর আদালতের রায় ব্যতীত তা আর প্রত্যাহার করা যায় না। কিন্তু উইল ইচ্ছেমত বাতিল করা যায়।
(৩) দান করার সময় দানের সম্পত্তিতে দাতার মালিকানা ও দখল থাকতে হবে অন্যদিকে মৃত্যুর পূর্বে পাওয়া যাবে এরূপ যে কোন সম্পত্তি উইল করা যাবে।
উইলের ফর্ম
উইলের জন্য ইসলামী আইনে নিদিষ্ট কোন ফরম নেই। মুসলিমের উইল লিখিত না হলেও চলে,
মৌখিক উইলও আইনগতভাবে সিদ্ধ। তবে সংগত কারণে প্রায় সবক্ষেত্রে উইল লিখিত হয়ে
থাকে। লিখিত না হলে অসুবিধা অনেক। মুখের কথার উপর সত্য প্রতিষ্ঠা করা খুবই
কঠিন। মৃত্যুকালে একটি চিঠি লিখে সম্পত্তির বিন্যাস সম্পর্কে নিদেশ দিয়ে গেলে
সেই চিঠিও উইলরুপে গন্য হতে পারে। লেখা সম্ভব না হলেও, শুধুমাত্র ইশারা বা
ভঙ্গীর মাধ্যমে উইল সৃষ্টি করা যায়। মুসলিমের উইল প্রত্যায়িত হওয়া অনাবশ্যক।
তবে আইনে যাই বলা থাকুক না কেন, মানুষের মন প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। যিনি উইল এর
দাতা তিনি মারা যাবার পর তার ওয়ারিশেরা যে কোন সময় উইল গ্রহিতাকে সম্পত্তি দিতে
বা উইলটিতে অসম্মতি জানাতে পারে এবং একজন মানুষ মারা যাওয়ার পর তার ইচ্ছার
সপক্ষে শক্তিশালী স্বাক্ষ্য-প্রমান উপস্থাপক করাও অনেক সময় মুষকিল হয়ে যেতে
পারে। তাই আমার মতে সব থেকে সেফওয়ে হল, লিখিত ভাবে উইলের দলিল প্রস্তুত করা এবং
সাবরেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে রেজিস্ট্রি করে রাখা।
উইল দলিল প্রণয়ন এবং রেজিস্ট্রি খরচ
উইল দলিল বা ওছিয়তনামায়, দলিলের দাতা এবং গ্রহিতা কে বা কারা, কোন সম্পত্তি ওছিয়ত করছেন, সেই সম্পত্তির বিবরণ ইত্যাদি লিখে কার্টিজ পেপারে প্রিন্ট দিতে হয়। এবং উইল দাতা যে এই জমির মালিক, এই জমি কোথাও বিক্রি করেন নাই কিংবা বন্ধক দেন নাই, অর্থ্যাৎ এটা একটা নিষ্কন্টক জমি বা সম্পত্তি এই মর্মে ২০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে একটা হলফ নামা মূল দলিলের সাথে সংযুক্ত করতে হয়।
আপনারা স্ক্রিনে ওছিয়ত নামা দলিলের এবং হলফনামার একটা টেমপ্লেট বা নমুনা দেখতে পাচ্ছেন।
নমুনা দেখতে এই লিংকে ক্লিক করুন
বর্তমানে একটা ওছিয়তনামা দলিল বা উইলের রেজিস্টেশন খরচ ৯০০ টাকা। এর মধ্যে রেজিস্টেশন ফি ২০০ টাকা, হলফ নামা ২০০ টাকা, ই-ফিস ১০০ টাকা, এন ফিস ১৬০ টাকা, এনএন ফিস ২৪০ টাকা সহ সর্বোমোট ৯০০ টাকা।
যেকোন ধরনের প্লট, ফ্লাট, সাফ-কবলা, হেবা, হেবার ঘোষণা, দানপত্র, উইল, বায়না পত্র, চুক্তি পত্র ইত্যাদি দলিলের রেজিস্ট্রেশন খরচ কয়েকটি ক্লিকে অনলাইনে বের করার পদ্ধতি জানতে আই বাটনে বা ভিডিয়ো ডিসক্রিপশনে দেওয়া লিংকে ক্লিক করে সাবলাইম লিগ্যালের এই ভিডিয়োটি দেখে আসতে পারেন।
আরো বিস্তারিত জানতে এই ভিডিয়োটি দেখে আসতে পারেন
পবিত্র কুরআনে অসিয়ত সম্পকে বলা হয়েছে-
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যখন কারও মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন অসিয়ত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে ধর্ম পরায়ণ দু’জনকে সাক্ষী রেখো। যদি তোমাদের সন্দেহ হয় তবে উভয়কে নামাজের পর থাকতে বলবে। অতঃপর উভয়ই আল্লার নামে কসম খাবে যে, যদিও কোন আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর সাক্ষ্য আমরা গোপন করব না। এমতাবস্থায় গোনাহগার হব।’ (সূরা আল মায়দা, ৫নং সূরা, আয়াত ১০৬)
‘তোমাদের কারও যখন মৃত্যু সময় উপস্থিত হয়, সে যদি কোন ধন সম্পদ ত্যাগ করে যায়, তবে তার জন্য অসিয়ত করা বিধিবদ্ধ করা হলো। পিতা-মাতা নিকটাত্মীয়দের জন্য ইনসাফের সাথে। পরহেজগারদের জন্য এ নির্দেশ জরুরি। নিশ্চিয় আল্লাহ তা’আলা সব কিছু শোনেন ও জানেন।’ (সূরা আল বাকারা, ২ নং সূরা, আয়াত ১৮০)
‘যদি কেউ অসিয়ত শোনার পর তাতে কোন পরিবর্তন সাধন করে তবে যারা পরিবর্তন করে তাদের উপর এর পাপ পতিত হবে।’(সূরা আল বাকারা, ২ নং সূরা, আয়াত ১৮১)
‘যদি কেউ অসিয়তকারীদের পক্ষ থেকে আশংকা করে পক্ষপাতিত্বের অথবা কোন অপরাধমূলক সিদ্ধান্তের এবং তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেয়, তবে তার কোন গোনাহ হবে না। নিশ্চই আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল।’ (সূরা আল বাকারা, ২ নং সূরা, আয়াত ১৮২)
মৌখিকভাবে উইল করা হলে উইলের সাক্ষীদের সহকারী কমিশনার (ভূমি) নোটিশ দিয়ে ডেকে পাঠাবেন। হাজির হলে তাদের জবানবিন্দ নিয়ে উইলের সত্যাসত্য যাচাই করে মিউটেশন করে দিতে পারবেন। উইল করা হলে উইলকারীর মৃত্যু না হলে উইল গ্রহীতার নাম কোন অবস্থাতেই মিউটেশন করে দেয়া যাবে না। উইলকারীর মৃত্যুর পরই উইল কার্যকরী হয়।
তো বন্ধুরা এইছিল ওছিয়তনামা বা উইল নিয়ে আজকের আলোচনা, পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন এবং এই রকম আরো আর্টিকেল পেতে চাইলে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাই করে রাখতে পারেন, দেখা হবে পরবর্তী পোস্টে, সেই পর্যন্ত ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।
5 Comments
আসসালামু আলাইকুম।
ReplyDeleteঅনেক উপকারী একটা আর্টিকেল এর জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Thank you. I was searching for it for a long time. Do you have any professional support to prepare a will? Please let me know.
ReplyDeleteswaponzaman1994@gmail.com
ReplyDeleteস্যার আমার দাদি ৭.৫০ শতাংশ জমি মধ্যে ৪.০০ জমি বিক্রি করে দিছে। বাকি ৩.৫০ শতাংশ জমি ভাইয়ের পূত্রকে অসিয়ত নামা দলিল করে দিয়ে যান। এক্ষেত্রে ৩.৫০ শতাংশ জমি সম্পূন অসিয়ত কী কার্যকর হবে? তিনি তো ১/৩ অংশ না দিয়ে সমর্পূনটাই দিয়েছেন। এখানে কী অসিয়ত কার্যকর হবে?
ReplyDeleteবন্টননামা দলিল রেজিস্ট্রেশনকালে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ এর ৫৩ এইচ ধারায় উৎসে আয়কর আদায় প্রসঙ্গে।
ReplyDelete